ফ্যাসিবাদীরা রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ নিতে ওঁৎ পেতে আছে: তারেক রহমান
নিউজ দর্পণ, রফিক মৃধা: ফ্যাসিবাদীরা রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ নিতে ওঁৎ পেতে আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশ নানান অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণে বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছে কি না তা নিয়েও বড় প্রশ্ন রয়েছে। ফ্যাসিবাদী অপশক্তি রাষ্ট্র-রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে রয়েছে। সরকারের যেকোনো ভুল সিদ্ধান্তে গণতন্ত্র উত্তরণের যাত্রাপথ সংকটে পড়তে পারে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ এবং উগ্রবাদও মাথাচাড়া দিতে পেরে।
আজ বুধবার আশুলিয়ার দারুল ইহসান মাদরাসার মাঠে শ্রমিক-ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থান ‘নারকীয় আশুলিয়া স্মরণ’ সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। গত বছর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পূর্বক্ষণে ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের লাশ ভ্যানে করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এ দিনটিতে নারকীয় হত্যাযঞ্জের ঘটনার স্মরণে বিএনপি এই জনসভার আয়োজন করে। প্রথমে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন সবাই। পরে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের পরিবারের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়া হয়। সমাবেশকে কেন্দ্র করে হাতে ব্যানার-ফেস্টুনসহ এলাকাজুড়ে মানুষের ঢল নামে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরসহ কয়েকটি অঞ্চলের হাজার হাজার নেতাকর্মী সমাবেশে অংশ নেয়। দুপুর গড়াতেই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল এসে যোগ দিতে থাকে মূল সমাবেশস্থলে।
তারেক রহমান বলেন, আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে পতিত পলাতক পরাজিত বিতাড়িত ফ্যাসিবাদী অপশক্তি রাষ্ট্র রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ নিতে ওঁৎ পেতে রয়েছে। সরকারের যে কোনো ভুল সিদ্ধান্তে দেশে গণতন্ত্র উত্তরণের যাত্রাপথকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ, চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কাজেই এই ব্যাপারে আমাদের সকলকে বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে, থাকা প্রয়োজন।
‘সরকারকে নাগরিকদের কথা শুনতে হবে বলে জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের মুখাপেক্ষী করা গেলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন করা সম্ভব। একই সঙ্গে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে। দেশের সর্বস্তরের জনগণ কয়েকজন মানুষের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দেয়ার জন্য দেড় দশক ধরে নিশ্চয়ই আন্দোলন অব্যাহত রাখেনি কিংবা জুলাইয়ের অভ্যুত্থানেও শহীদ হননি। জনগণ রাষ্ট্র এবং সরকারে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদকে হটিয়েছে, জীবন উৎসর্গ করেছে। সুতরাং সরকারে যখন যারাই থাকুক কেউ সরকার পরিচালনা করতে চাইলে তাদেরকে অবশ্যই নাগরিকদের কথা শুনতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের আশা, ভাষা বুঝতে হবে। কেউ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে হলে তাকে অবশ্যই জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। বিএনপি জনগণের ক্ষমতায়নের এই রাজনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শহীদদের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায়। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ হটিয়ে জনগণ রাষ্ট্র এবং সরকারে নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার অর্পণ করেছে। এখন জনগণের মালিকানা জনগণের হাতে দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাঝে শোনা যায় যে সকল কথা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি অংশ নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। শিক্ষাঙ্গন, স্থানীয় সরকার কিংবা জাতীয় সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে বিএনপি জনগণের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার পক্ষে। কিন্তু এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অগ্রাধিকার নির্ধারণে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারছে কি না এটি একটি বিরাট প্রশ্ন এই মুহূর্তে জনগণের সামনে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমি আগেও বলেছি শহীদগণ কিন্তু শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়। একটি প্রাণের সমাপ্তির অর্থ একটি পরিবারের মৃত্যু, একটি স্বপ্ন সম্ভাবনার অবসান। তবে আপনাদের সন্তান স্বজনের শহীদ মৃত্যু দেশ এবং জনগণকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছে। দেশ আপনার শহীদ সন্তানের কাছে ঋণী। প্রতিটি শহীদ পরিবারের প্রতি রাষ্ট্র এবং সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষ যাতে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শহীদদের অবদান নিয়ে গর্ব করতে পারে, শ্রমজীবী কর্মজীবী শহীদ পরিবারের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সদস্যরা যাতে তাদের স্বজনদের শহীদ মৃত্যু নিয়ে গৌরব করতে পারেন। বিএনপি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জনগণের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে সাভার-আশুলিয়া কিংবা অন্য কোনো সুবিধাজনক এলাকায় শ্রমজীবী- কর্মজীবী মানুষের আত্মত্যাগের সম্মানে একটি বিশেষ স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২৪ সালের অভ্যুত্থান পর্যন্ত শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আল্লাহ যেন প্রতিটি আত্মত্যাগকে শহীদ মৃত্যু হিসেবে কবুল করেন… আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা করছি। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। একই সাথে শহীদদের সম্মানার্থে তাদের স্বজন-পরিবারের সদস্যদেরকে তাদের মনের কথা তুলে ধরার জন্য এই অনুষ্ঠান আয়োজন যারা করেছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকে অনেক রকম কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক বাদানুবাদ হচ্ছে, হবেই, গণতন্ত্রের সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কোনো কিছু করবেন না যাতে আবার গণতন্ত্র ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের সেটাই আহ্বান থাকবে। আমাদের আহ্বান থাকবে যে, ছোটখাটো বিষয়গুলো নিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করবেন না, যে অবস্থায় আবার সেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা কোনো সুযোগ পায় দেশে ফিরে আসার। আমরা অনুরোধ করব সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে, আসুন আমরা অতি দ্রুত আমাদের যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলোকে মিটিয়ে ফেলে আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাই। একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা একটা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করি। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এই মহিলা (শহীদ পরিবারের এক সদস্য) যে অভিযোগ করেছেন সে অভিযোগ আমাদেরকে শুনতে হতো না। আমি যারা এই অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি এ জন্যে যে একটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটি আয়োজন করেছেন এবং এতে করে জাতির বিবেক জেগে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, আমি এটা বিশ্বাস করি যে তারেক রহমানের নেতৃত্বে আজকে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আমরা অবশ্যই গণতন্ত্রে ফিরে যেতে সক্ষম হব এবং আজকে যারা বিচার পাচ্ছেন না তাদের বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হব, তাদের জীবনের ব্যবস্থা করতে আমরা সক্ষম হব। মির্জা ফখরুল বলেন, আমি আজকে হতবাক হয়ে গেছি, এই দৃশ্য দেখা যায় না। আমরা কোন দেশে আছি একমাত্র মুসোলিনি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলার গ্যাস চেম্বারে নিয়ে মানুষকে হত্যা করেছিল আজকে দেখলাম আমাদের দেশে হাসিনা ছাত্রদেরকে পুড়িয়ে মেরেছে। এখানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্বজনদের বক্তব্যের পরে বক্তব্য রাখার খুব একটা মানসিক অবস্থা থাকে না, আজকে সেটা নেই। আমি নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে যে, আমরা কেমন একটা জাতি যে জাতি আমরা আমাদের ছেলেদেরকে পুড়িয়ে মারি। কেমন একটা জাতি যে, আমাদের রাষ্ট্রের যারা কর্মচারী-কর্মকর্তা তারা সন্তানদেরকে হত্যা করে এবং পরে পুড়িয়ে হত্যা করে। এখানে একজন মা বক্তব্য রাখছিলেন যে, তার ছেলে বেঁচে ছিলো সেই অবস্থায় তাদেরকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার একজনের অভিযোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, এখানে একজন বললেন, তার কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। আমি ঢাকার ডিসিকে এখান থেকে বসেই ফোন করেছিলাম তারা সরকার কমিট করেছিলেন যে যারা আহত এবং শহীদ বিশেষ করে যারা শহীদ হয়েছে তাদের পরিবারগুলোকে ১০ লক্ষ টাকা করে তারা প্রাথমিকভাবে অনুদান দেবেন আর যারা আহত হয়েছে তাদের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে। আমি মাত্র দুজনকে এখানে পেয়েছি যারা সেই টাকাটা পেয়েছেন বন্ড হিসেবে। বাকিদের আমি জানি না। একটা ছোট বাচ্চা ছেলে আট বছর বয়স। তার মাথার খুলিটা উড়ে গিয়েছিল। সেটাকে আর্টিফিশিয়াল প্লাস্টিক দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছিলো। হাসিনা ভারত থেকে উস্কানি দিচ্ছে বলে জানিয়ে মির্জা ফখরুল ক্ষোভের সুরে বলেন, আমরা এমন একটা জাতি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের নেতা যারা আমাদের নেতৃত্ব করে, যাদেরকে দেশের মানুষ নেতা বলে মনে করে, তারা ক্ষমতায় চিরদিন টিকে থাকার জন্য এভাবে গুলি করে মানুষকে হত্যা করে যেটা হাসিনা করেছে। এখনও তীব্র স্বরে হাসিনার বিচার চায়, গোটা জাতি হাসিনার বিচার চায়। আপনারা জানেন যে, হাসিনা পালিয়ে গেছে ভারতে, ভারত তাকে আশ্রয় দিয়েছে। আপনারা দেখেছেন যে, সে সেখান থেকে অডিও ভার্সনে কথায় ভিডিওতে এখানে আবার বাংলাদেশের নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন রকম সেই উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করছে এবং চেষ্টা করে গোপালগঞ্জে ইতিমধ্যে তারা সেই অবস্থা তৈরি করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমি বলব একটি কথা, ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে কিন্তু এনজিওবাদ আজকে দেশ চালাচ্ছে। এখান থেকে কিভাবে মুক্তি নেবেন সেই পথ নির্দেশনা দেবেন আমাদের নেতা এটাই প্রত্যাশা করি। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান বলেন, যেভাবে এই আশুলিয়াতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ফ্যাসিস্টরা সেই ফ্যাসিস্টদের প্রধান শেখ হাসিনার বিচার এদেশের মাটিতে হতেই হবে। জিয়াউর রহমান তথা জিয়া পরিবার সবসময়ে দেশের দুর্দিনে দেশের মানুষের পাশে ছিলো, তারেক রহমান দেশকে এগিয়ে নেবেন, তিনি সবসময় জনগণের পাশে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।
ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সহ-পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন বাবু, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক, শহীদ পরিবারের মধ্যে বাবুল হোসেনের স্ত্রী লাকি আখতার, আরাফাত মুন্সির বাবা স্বপন মুন্সি, বায়েজিদ মুস্তাফিজের স্ত্রী রিনা আখতার, শ্রাবন গাজীর বাবা আবদুল মান্নান গাজী, মামুন খন্দকার বিপ্লবের স্ত্রী খন্দকার সাথী, সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা বেগম, আরাফুর রহমান রাসেলের ভাই সায়েদুর রহমান বাবু, জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে পঙ্গু শান্ত প্রমুখ।