প্রধান নিউজলীডসারাদেশ

সারেনি পুরোনো ক্ষত, বন্যায় ফের জর্জরিত পরশুরাম

নিউজ দর্পণ, ঢাকা : ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ফেনীর পরশুরামে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতির ১১ মাস অতিবাহিত হয়েছে। তবে এখনো সংস্কার হয়নি অর্ধশত সড়ক, পোল ও সেতু। এরইমধ্যে এ বছর আবারো শুরু হয়েছে বন্যা। আগের ক্ষত না শুকাতেই আবারো বন্যার আঘাতে জর্জরিত স্থানীয়রা।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট শুরু হওয়া বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ। বন্যায় ভেঙে যায় সড়ক, সেতু ও ছোট ছোট পোল। এর মধ্যে ৯টি সেতু, ৩টি পোল ধসে যায়, ৪০টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব সড়ক ও সেতু এখন ব্যবহারের অযোগ্য।
এলজিইডি পরশুরাম উপজেলা প্রকৌশলী এসএম শাহ আলম ভূঁইয়ার দাবি, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও সেতু মেরামতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চেয়ে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সড়কে বন্যায় ভেঙে যাওয়া ৪০টি স্থান মেরামত করা হয়েছে। ‘গেল বছরের বন্যার মতো এবারও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা নিয়ে ভুগতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।’

এলজিইডির উপজেলা অফিস সূত্র জানায়, উপজেলার মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ ও পৌরসভায় ৯৫ কিলোমিটার সড়ক গত বন্যায় ভেঙে যায়। এর মধ্যে প্রায় ১০টি সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। অন্যান্য সড়কগুলোর কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছে। সড়ক মেরামতে ২ কোটি ২৭ লাখ টাকার চাহিদা দেয় এলজিইডি। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ১২টি পোল ও আরসিসি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব পুনর্নির্মাণে ৫ কোটি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়।

গত বন্যায় বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও সেতু ভেঙে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের পালপাড়া-জঙ্গলঘোনা সড়কে প্রায় ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত আরসি গার্ডার সেতুটি ধসে পড়ে। সেতুর দুই পাশে প্রায় ১০ ফুট দূরত্বে মাটি সরে যায়। এতে বন্ধ হয়ে যায় যাতায়াত ব্যবস্থা।

এদিকে গত বছরের বন্যার ক্ষত না মিটতেই এবছর আবারো বন্যার কবলে পড়েছে পরশুরাম উপজেলা। টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীরক্ষা বাঁধের ২১টি স্থানে ভেঙে প্লাবিত হয়েছে শতাধিক গ্রাম। ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন ২০ হাজার মানুষ। বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। ‘কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ছাদে আশ্রয় নিয়েছি। গেলো বছরের বন্যাতেও সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে। বছর না ঘুরতে আবার আমাদের স্বপ্ন পানিতে ডুবছে।’

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, পরশুরামের ১২টি ও ফুলগাজী উপজেলায় ৯টিসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মোট ২১টি স্থান ভেঙে গেছে। তার মধ্যে মুহুরী নদীর ১১টি, কহুয়া নদীর ৬টি ও সিলোনিয়া নদীর ৪টি অংশে ভাঙনে ১০০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাদুর্গত ৬ হাজার ৮২৬ জন মানুষ অবস্থান করছে। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এরইমধ্যে ৯০ জন স্বেচ্ছাসেবক মাঠে কাজ করছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে রান্না করা ও শুকনো খাওয়ার বিতরণ করছে প্রশাসন। পানির স্রোতের কারণে ফেনী-পরশুরাম সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

ফুলগাজীর বাসিন্দা আব্দুল হক বলেন, বৃষ্টি কিছুটা কমেছে, সঙ্গে নদীর পানিও কমছে। ভাঙন স্থানগুলো দিয়ে এখনো পানি ঢুকছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গেল বছরের বন্যার মতো এবারও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা নিয়ে ভুগতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।

পরশুরামের মধ্যম ধনীকুন্ডা এলাকার বাসিন্দা নাহিদা সুলতানা বলেন, সন্ধ্যার পর ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ছাদে আশ্রয় নিয়েছি। গেলো বছরের বন্যাতেও সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে। বছর না ঘুরতে আবার আমাদের স্বপ্ন পানিতে ডুবছে।

‘পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে প্রায় ২০ হাজার মানুষ দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরইমধ্যে ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।’

মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব রাঙামাটিয়া এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে বল্লামুখা বাঁধের প্রবেশ মুখটি বন্ধ করা হয়নি। সময়মতো বাঁধের এ স্থানটি বন্ধ করা হলে পানি প্রবেশের সুযোগ ছিল না। প্রতিবছরই কিছু মানুষের দায়সারা কাজের কারণে বড় একটি জনগোষ্ঠীকে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

পরশুরামের তুলাতলী এলাকার বাসিন্দা শহীদ উল্লাহ বলেন, চারদিকে থইথই পানি। বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।

ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, জেলায় টানা তিন দিন ধরে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারও জেলাজুড়ে হালকা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে প্রায় ২০ হাজার মানুষ দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরইমধ্যে ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলার ৬ উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *