বানের পানির সঙ্গে ভারতীয় গরু দেশে প্রবেশ করাচ্ছে চোরাকারবারিরা

নিউজ দর্পণ ডেস্ক: ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে নিজেদের গরু হাটে তোলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছেন দেশের খামারি ও গৃহস্থরা। কিন্তু তাদের আশায় ছাই ছিটাতে বানের পানির সঙ্গে ভারতীয় গরু দেশে প্রবেশ করাচ্ছে চোরাকারবারিরা। কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের স্রোতে ভেসে প্রতিদিন ভারতীয় গরু ঢুকছে বাংলাদেশে। এতে আসন্ন ঈদে দেশীয় গরুর খামারি ও গৃহস্থরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্তে কঠোর নজরদারি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ালে দেশের খামারিরা লাভবান হবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার সীমান্তপথে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে প্রতি রাতে শত শত গরু ও মহিষ দেশের সীমানায় প্রবেশ করানো হচ্ছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দই খাওয়া, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়ন এবং নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সীমান্তের নদীপথে প্রচুর ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এসব গরু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলার হাটগুলোতে বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে। সেখান থেকে ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট জেলার গরু ব্যবসায়ীরা।

তবে বিজিবি বলছে, সীমান্তে নজরদারিসহ টহল জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া ও নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে চোরাকারবারিরা বিভিন্নভাবে সীমান্তের নদীপথে গরু প্রবেশ করাচ্ছে। গরুর লট প্রবেশের খবর পাওয়া মাত্র তা সিজ করা হচ্ছে।

মঙ্গলবার (৭ জুলাই) জেলার সদর উপজেলার যাত্রাপুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, হাটে দেশি গরুর চেয়ে ভারতীয় গরু-মহিষের সমাগম বেশি। পানিপথ অতিক্রম করা এসব গরুর গায়ে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে সেগুলো প্রকাশ্যে বিক্রির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। আবার অনেক গরু ট্রাকবোঝাই করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হাটে কোনও অনুমোদিত বিট বা খাটাল ব্যবস্থা না থাকলেও সেখানে গরুপ্রতি ১৫০ টাকা করে বিট আদায় করছে একটি চক্র।

যাত্রাপুর হাটে ভারতীয় গরু বিক্রি করতে আসা একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলমান বর্ষা মৌসুমে নদ-নদীতে পানির প্রবাহ বেশি থাকায় বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীপথে প্রচুর ভারতীয় গরু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভাসিয়ে পাচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের পর এসব গরু ডাঙাল দিয়ে স্থলে তুলে নিয়ে হাটে তোলা হচ্ছে। সেখান থেকে এসব গরু আসন্ন কোরবানি ঈদের হাটে বিক্রির উদ্দেশে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে যাত্রাপুর হাটের একাধিক ভারতীয় গরু বিক্রেতা জানান, বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক আবহাওয়ায় প্রতি রাতে দেড় থেকে দুইশ’ গরু ভারতীয় সীমান্ত হতে নদীপথে বাংলাদেশের জলসীমায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তবে আবহাওয়া খারাপ হলে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। সীমান্ত পথে জলসীমানায় নির্বিঘ্নে গরু প্রবেশ করাতে লাইনম্যানদের গরুপ্রতি নির্দিষ্ট হারে (বাছুরপ্রতি ৫০০ এবং বড় গরু এক হাজার) টাকা প্রদান করা হয়। এরপর ব্যবসায়ীরা তাদের ডাঙাল দিয়ে সেসব গরু ডাঙায় তুলে নিয়ে হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। ইজারাদারদের গরুপ্রতি ৩৫০ টাকা দিয়ে এসব গরু বিক্রি করা হয়।

তবে হাটে বিক্রির সময় এসব গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই বলে জানান বিক্রেতারা।

যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, যাত্রাপুর হাটে ভারতীয় গরু বিক্রির আইনগত কোনও বৈধতা নেই। এখানে কোনও বিট বা খাটাল কিংবা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নেই। কিন্তু কীভাবে একটি চক্র এসব অবৈধ ব্যবসা করে দেশের গরু ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করছেন তা তারা (হাট কর্তৃপক্ষ) এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভালো জানেন। এসব গরুর কোনও করিডোরও হচ্ছে না। ফলে সরকার মোটা অংকের রাজস্বও হারাচ্ছে।

তবে যাত্রাপুর হাটের ইজারাদার মো. আনোয়ার হোসেন দাবি করেন, বিজিবি ভারতীয় গরুপ্রতি ৫০০ টাকা করিডোর ফি আদায়ের বিনিময়ে হাটে বিক্রি এবং ট্রাকযোগে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহের অনুমতি দিয়ে থাকে।

তার দাবি, ‘করিডোর ফি আদায়ের কাগজ নিয়েই এসব গরু হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হয়। এরপর বিজিবি এসব গরু ধরলা সেতু পার হওয়ার অনুমতি দেয়।’

জানতে চাইলে বিজিবি-২২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ জামাল হোসেন জানান, নদ-নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় সীমান্তপথে ভারতীয় গরুর চোরাচালান বেড়ে গেলেও তা প্রতিরোধে বিজিবি তৎপর রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু গরু সিজ করেছি। তবে বন্যা এবং বৈরী আবহাওয়ায় সীমান্তে নজরদারি বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে চোরাকারবারিরা। বিজিবিও নৌপথে টহল জোরদার করেছে। এরপরও যদি কোনও ভারতীয় গরু পাচারের খবর পাওয়া যায় তাহলে বিজিবি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

যাত্রাপুর হাটে করিডোর কিংবা বিট খাটালের অনুমতি দেওয়া হয়নি জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘দেশীয় খামারি ও গরু ব্যবসায়ীদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সীমান্তপথে ভারতীয় গরু পাচার রোধে প্রশাসন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের (ইউএনও) এ বিষয়ে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় গরুর পাচার রোধে আমাদের টাস্কফোর্স কাজ করছে।’

তবে এ বিষয়ে বিজিবির আরও তৎপরতা প্রত্যাশা করেন জেলা প্রশাসক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *