বন্যা পরিস্থিতির অবনতি : দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি

নিউজ দর্পণ ডেস্ক: বৃষ্টি কমলেও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে প্রধান চারটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ৫৬ ইউনিয়নের চার শতাধিক গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদিকে তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার রাজারহাট, ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বারী, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার এলাকার পর এলাকা প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার পরিবারের লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শুকনো জায়গার অভাবে রান্নার বিড়ম্বনায় পড়েছে পানিবন্দি এসব পরিবার। পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট ও স্যানিটেশন সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করছে। বয়োবৃদ্ধ ও শিশুসহ গবাদি পশু নিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন বানভাসিরা। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিলেও বেশিরভাগ পরিবার নিজ বাড়িতেই পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
উলিপুর উপজেলার হাতিয়া, সাহেবের আলগা, বেগমগঞ্জ, বুড়াবুড়ি, থেতরাইসহ ৮টি ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারের লোকজন গবাদি পশু নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রসহ নিরাপদ স্থানের দিকে ছুটছে। একই পরিস্থিতি নাগেশ্বরী, রাজারহাট, চিলমারী ও রৌমারী উপজেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন ইউনিয়নের।

অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে নদ-নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চলসহ চর ও দ্বীপচরগুলো প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার তথ্যানুযায়ী পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার। বন্যাকবলিত ৫৬ ইউনিয়নের বেশ কিছু জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্যাকবলিত এসব ইউনিয়নে পানিবন্দি লোক সংখ্যা দুই লক্ষাধিক।
পাউবো জানায়, উজানে ভারতের বেশ কিছু এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় জেলার সবক’টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) সকাল ৬টা পর্যন্ত ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, তার ইউনিয়ন পুরোটাই পানিবন্দি। চরাঞ্চল অধ্যুষিত এই ইউনিয়নে প্রায় ৬ হাজার পরিবারের ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছে। এদের মধ্যে অনেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। চেয়ারম্যান বলেন, ‘পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। আমার নিজের বাড়িতেও পানি। ইউনিয়নের সব পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা খাদ্য সহায়তা দেওয়া শুরু করেছি।
একই অবস্থা সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলওয়ার হোসেন বলেন, আমার নিজেরসহ ইউনিয়নের প্রতিটি পরিবার পানিবন্দি। ধরলার পানি বৃদ্ধি পেয়ে সব পরিবারের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। লোকজন ইউনিয়ন পরিষদ ভবনসহ বিভিন্ন স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা বরাদ্দকৃত চাল ও শুকনা খাবার বণ্টনের ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এই দু’টি ইউনিয়ন ছাড়াও সদর উপজেলার ঘোগাদহ, হলোখানা ও ভোগডাঙা ইউনিয়নসহ পৌর এলাকার চর ভেলাকোপার শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হানিফা জানান, তার ইউনিয়নের শতভাগ মানুষ পানিবন্দি। বন্যা আর ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন তারা। শুকনো খাবারের অভাবে পানিবন্দি মানুষ খাদ্য কষ্টে আছেন।

তিনি বলেন, ‘বানভাসি মানুষের কষ্ট আর ভোগান্তি দেখলে চোখে পানি এসে যাবে। আপনারা আসুন, দেখে যান।’
জেলা প্রশাসন বলছে, বন্যাকবলিতদের জন্য ৪৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়াও বিশেষ পরিস্থিতিতে বানভাসিদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনার জন্য ২০টি নৌযান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানিসহ যেকোনও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, উজানের ঢলে জেলার সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে এর অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তবে ধরলা ও তিস্তার পানি কমতে শুরু করবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বন্যায় পানিবন্দি লোকজনকে নিরাপদ স্থানে এবং আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। তাদের সহায়তায় চাল ও শুকনো খাবারসহ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া শিশু ও গোখাদ্য বিতরণেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *