গুম একটি পরিবারের এবং প্রিয়জনদের সমস্ত জীবন বদলে দেয়: আলী রীয়াজ
নিউজ দর্পণ, ঢাকা: গুমের শিকার মানুষদের স্মরণে ৩০ আগস্ট সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ দ্য ভিক্টিমস অফ এনফোর্সড ডিসএ্যাপেয়ারেন্স’। সহজ করে বললে ‘গুম প্রতিরোধ দিবস’ বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে গুমের ঘটনাকে সরকারীভাবে অস্বীকার করা হলেও দেশের অসংখ্য পরিবার যে তাঁদের প্রিয়জনদের জন্যে অপেক্ষায় আছেন সে কথা সকলেই জানেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬২৩ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন এবং এঁদের মধ্যে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৩ ব্যক্তি (প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট ২০২৩)। শুধু তাই নয়, গুমের শিকার মানুষদের ৮৪ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে সেন্টার গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) পক্ষ থেকে আমরা গুম বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম, ‘হয়্যার আর দে?’ (কোথায় আছেন তাঁরা?)। তাতে আমরা গত তিন বছরে (২০১৯-২১) গুমের অভিযোগ উঠেছে এমন ৭১টি ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিলাম। এই ৭১ জনের মধ্যে ১৬ জনকে মার্চ (২০২২) পর্যন্ত পাওয়া যায়নি; ৫ জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। ২২ জনের ব্যাপারে পরিবারের অভিযোগ ছিল যে তাঁদের ‘তুলে নেওয়া’ হয়েছে। এই অভিযোগের পর তাঁদের হয় আটক দেখানো হয়েছে বা তাঁদের জেলে পাওয়া গেছে।
কিন্ত সংখ্যা দিয়ে বিচার করলেই এই প্রপঞ্চের মাত্রা এবং প্রভাব বোঝা যাবেনা। এর একটি দিক হচ্ছে মানবিক দিক, বিবেচনা করার বিষয় হচ্ছে গুম কেবল একটি মানুষের অনুপস্থিতি নয় – গুম একটি পরিবারের এবং প্রিয়জনদের সমস্ত জীবন বদলে দেয়।
এক অন্তহীন অপেক্ষা আর বেদনার ভার বইতে হয়। সে সন্তান তাঁর পিতাকে দেখতে পেলোনা, যে সন্তান বড় হচ্ছে এই আশা নিয়ে যে একদিন তাঁরা বাবা ফিরে আসবেন তাঁদের কথা ভাবুন। গুমের আরেকটি দিক হচ্ছে এই অপরাধকে আন্তর্জাতিক আইনে কীভাবে বিবেচনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক আইনে এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স মানুষের মৌলিক অধিকারের সবচেয়ে গুরুতর লঙ্ঘনগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত । একে আন্তর্জাতিকভাবে ‘মানবমর্যাদার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে গণ্য করা হয় (দেখুন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব, ১৯৯২ A/RES/47/133, art.1)। একে বিবেচনা করা হয় ‘মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর এবং ঘৃণ্য অপরাধ’ হিসেবে (ওএএসের ঘোষণার প্রস্তাবনা)। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বলেছে যে বলপূর্বক অন্তর্ধান ‘মানুষের মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ, মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার গুরুতর এবং সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম লঙ্ঘন’ (১৯৯৪, A/RES/49/193; ১৯৯৬, A/RES/51/94;, ১৯৯৮, A/RES/53/150)। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধিতে বলা হচ্ছে যে সিস্টেম্যাটিক বা পদ্ধতিগতভাবে (অর্থাৎ উপর্যুপরিভাবে) কিংবা ব্যাপক আকারে ‘অন্তর্ধান’-এর অনুশীলন ‘মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ’ বলে বিবেচিত হতে পারে [অনুচ্ছেদ ৭(২)(১)]।
বাংলাদেশ রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। ফলে এসব কথা বাংলাদেশের জন্যও যে সমপরিমাণ কার্যকর ৩০ আগস্ট ২০২৩-এ তা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
[লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া]