ম্যালেরিয়া নির্মূলে কাজে আসছে না সরকারি উদ্যোগ
নিউজ দর্পণ, ঢাকা: মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে ছড়ায় এ রোগ। দেশে ম্যালেরিয়া নির্মূলে সরকারিভাবে গতানুগতিক নানান উদ্যোগ নেওয়া হলেও মশা ও মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনে তা কোনোভাবে কাজেই আসছে না। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্য গ্রহণ করেছে। তবে লক্ষ্য অর্জনের বদলে প্রতিবছর বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সাধারণত পার্বত্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার বাহক মশা সবচেয়ে বেশি থাকলেও সম্প্রতি ঢাকায় অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে গতানুগতিক ধারায় কার্যক্রম পরিচালনা করলে ২০৩০ সালের মধ্যে বা তারও বেশি সময়েও লক্ষ্য পূরণ হবে না। শুধু অপচয় হতে থাকবে সরকারি অর্থ। সেজন্য প্রয়োজন মশা নির্মূলের পদ্ধতিতে নতুনত্ব। এমন পরিস্থিতি আজ বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। এবারে দিবসটির প্রতিপ্রাদ্য ‘ন্যায়সঙ্গত বিশ্বের জন্য ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই আরও গতিশীল করতে হবে’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ। আর এতে মৃত্যু হয়েছে ৬ লাখ মানুষের। ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর ৯০ শতাংশই হয়েছে আফ্রিকা অঞ্চলে।
সরকারের ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের পরবর্তী চার বছরে রোগী বেড়েছে কয়েক গুণ। এরমধ্যে ২০২২ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ছিল সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ১৯৫ জন। অন্যদিকে মৃত্যু হয়েছিল ১৪ জনের। এর তুলনায় গত বছর, ২০২৩ সালে আক্রান্ত কিছুটা কমে হয়েছিল ১৬ হাজার ৫৬৭ জন, আর মৃত্যূ হয়েছে ৬ জনের। ২০২১ সালে আক্রান্ত হয় ৭ হাজার ২৯৪ জন ও মৃত্যু হয় ৯ জনের। ২০২০ সালে আক্রান্ত ছিল ৬ হাজার ১৩০ জন ও মৃত্যু ৯ জনের। ।
অন্যদিকে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ১৫৮ জন। আক্রান্তদের সবচেয়ে বেশি রাঙ্গামাটিতে, ৪৩ শতাংশ। ৪০ শতাংশ বান্দরবান ও ১২ শতাংশ কক্সবাজারে। এসময়ে মারা গেছেন দুজন।
এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেশের ১৩টি জেলাকে ম্যালেরিয়াপ্রবণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি। এছাড়া নিম্নঝুঁকি এলাকার মধ্যে রয়েছে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কুড়িগ্রাম, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার।
সরকারের ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, বান্দরবান এলাকায় সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে দেশে মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ ছিল বান্দরবানে। এর আগে ২০২২ সালে ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ ও ২০২১ সালে ৭১ দশমিক ৭ শতাংশ রোগী ছিল বান্দরবানের।
অন্যদিকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রাঙ্গামাটিতে ২০২৩ সালে ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, ২০২২ সালে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও ২০২১ সালে ২১ দশমিক ৩ শতাংশ রোগী ছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথভাবেই ম্যালেরিয়া নির্মূলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এছাড়া দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে সবার যাওয়া সম্ভব হয় না, সেখানকার মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। পাহাড়ি এলাকাগুলোয় যারা বাহিরে কাজ করে থাকে সেখানে মশারি ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। তাদের ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচাতে নতুন করে সমাধান দিতে হবে। যেমন তারা মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশানিরোধক ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন।
তিনি বলেন, অন্যদিকে মশা ও মানুষের জীবনে বৈচিত্র্য এলেও ম্যালেরিয়া নির্মূলের পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ কারণেই সম্ভব হচ্ছে না মশা নির্মূল কিংবা রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনা। ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে হলে প্রথমে গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি। অন্যথায় গতানুগতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা সম্ভব নয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা ও সেই মশার লার্ভা খুঁজতে গিয়ে অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পেয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একদল গবেষক। জানা যায়, গত ২৩ মার্চ পূর্ণাঙ্গ অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পান তারা। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য গবেষণা শেষে প্রকাশ করা হবে।
এ বিষয়ে দলটির প্রধান ডা. কবিরুল বাশার জানান, ঢাকায় ম্যালেরিয়ার বাহক পাওয়া আমাদের মাঝে নতুন শঙ্কার বিষয়। আমরা ডিএনসিসির যে এলাকা থেকে মশার লার্ভা পেয়েছি সেখানে পূর্ণাঙ্গ অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এছাড়া আরও অনেক লার্ভা আছে সেখানে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. ম ম আক্তারুজ্জামান বলেন, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা আশাবাদী। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। তবে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো পার্বত্য তিন জেলা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ রোগী বান্দরবানে। আমাদের দেশের নির্দিষ্ট সীমান্ত রয়েছে কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকায় ঝুঁকি এবং প্রকোপ অনেক বেশি। আমরা যদি আগতরতলাসহ বিভিন্ন সীমান্তবর্তী ক্রসগুলো ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারি, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী নিদিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সমস্যা হবে না।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, রোগী না কমার পেছনে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কিছু এলাকা আছে যেখানে রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা ওয়ান থ্রি সেভেন ফর্মূলা অনুযায়ী কাজ করছি। অর্থাৎ, ম্যালেরিয়া রোগের শনাক্তকরণ করতে হবে একদিনের মধ্যে, ৩ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ম্যালেরিয়া নিশ্চিত করে রিপোর্ট দিতে হবে এবং ৭ দিনের মধ্যে আশপাশে কোনো রোগী আছে কি না তারও খোঁজ নিতে হবে। এ ফর্মূলা ব্যবহার করে চীন ম্যালেরিয়া নির্মূল করেছে। প্রতিটি রোগী আমরা ফলো করছি। গবেষণা ও সার্ভিল্যান্স বৃদ্ধি করাসহ বিনামূল্যে মশারি এবং ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।