আল্লামা আহমদ শফী আর নেই
নিউজ দর্পণ, ঢাকা : হেফাজত আমির আল্লামা আহমদ শফী আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আলতাফ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এর আগে শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টায় হেফাজত ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর শারীরিক অবস্থা অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। এরপরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা আল্লামা শফীকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে শুক্রবার সন্ধ্যার আগে ঢাকায় এনে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আহমদ শফী: হাটহাজারী মাদ্রাসার কর্তৃত্ব ছাড়তে বাধ্য হলেন:
বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামীর আমীর আহমদ শফী হাটহাজারীর মাদ্রাসায় বিােভের মুখে তার কর্তৃত্ব হারিয়েছেন। তিনি মাদ্রাসার পরিচালকের পদ ছেড়েছেন। তার ছেলে আনাস মাদানীকেও মাদ্রাসার শিকের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। দু’দিন ধরে ছাত্র বিােভের মুখে গত রাতে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি বা শূরা কমিটির বৈঠক করা হয়। গত রাত ১টায় সেই বৈঠক শেষ হলে জানানো হয় যে মি: শফী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য নোমান ফয়েজী বলেছেন, তাদের বৈঠকে উপস্থিত থেকে আহমদ শফী নিজে থেকে সরে গেছেন। মি: শফীকে মাদ্রাসার পরিচালকের পদ ছাড়তে হলেও তাকে মাদ্রাসার উপদেষ্টা হিসাবে রাখা হয়েছে। মি: ফয়েজী আরও জানিয়েছেন, পরিচালকের পদে কাউকে নিয়োগ করা হয়নি। কয়েকমাস আগে সহকারি পরিচালক হিসাবে শেখ আহমদ নামে যাকে নিয়ে নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি সহকারি পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করাবেন। পরিচালনা কমিটি এখন নিয়মিত বৈঠক করে মাদ্রাসা পরিচালনা করবেন।
মি: শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসায় বিােভের মধ্যে দু’দিন আগে পরিচালনা কমিটির বৈঠক থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। তবে মি: শফীর পরে একজন শিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শতবর্ষী আহমদ শফী খুবই অসুস্থ ছিলেন এবং তার কোন কিছু চিন্তা করার বা বোঝার মত পরিস্থিতি ছিল না বলে তারা মনে করেন। ঐ শিক অভিযোগ করেছেন, একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষকে বিােভের মুখে জোর করে বৈঠকে রেখে একতরফা সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে রাত ১টার পর মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির বৈঠক শেষ হলে মি: শফীকে চট্টগ্রাম শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মি: শফীর সমর্থক শিকদের অভিযোগ হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে মাদ্রাসায় একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। এজন্য তারা মি: শফীর অনুসারী মাদ্রাসাটির সিনিয়র শিক জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। মি: বাবুনগরীর সমর্থক শিকরা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে মাদ্রাসার কতৃত্ব নিয়ে দীঘদিন ধরে সেখানে দ্বন্দ্ব চলছিল, দুই পরে সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। শেষপর্যন্ত চ্যালেঞ্জের মুখে মি: শফীকে মাদ্রাসার কর্তৃত্ব হারাতে হলো।
আল্লামা শফির পতন যেভাবে : শুধু হাটহাজারী মাদ্রাসা নয়, কওমি অঙনের মূল সংগঠন হেফাজতে ইসলামির শিরোমনি ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফি। তিনি যাই বলতেন তাই শেষ কথা ছিল একসময়। সম্মানের এমন আসনে আসীন ছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ মাত্র দু‘দিনের ছাত্র বিােভে পতন হল আল্লামা শফির।
কেন হল? সেটাও কমবেশি সবার জানা। তবে কিভাবে হল? এর পেছনে কলকাঠিই বা নাড়ল কারা, তা জানা নেই অনেকের। ফলে এ প্রশ্ন খোদ কওমি অঙনেও ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। আর সচেতন মহল তো হণ্যে হয়ে খুঁজছে এসব প্রশ্নের উত্তর। সচেতন মহলের মতে, আল্লামা শফি ও জুনাইদ বাবুনগরীর বিরোধ দীর্ঘদিনের। সেই শাপলা চত্বর থেকে শুরু এই বিরোধের। বিরোধ নিয়ে দু‘পরে বিবৃতি প্রায়ই গণমাধ্যমে আসতো। এরমধ্যেও জুনাইদ বাবুনগরী সতর্ক অবস্থানে ছিলেন সবসময়। যদি বিবৃতির কোন অংশে কষ্ঠ পান মুরুব্বী আল্লামা শফি! তাই তিনি বিরোধকে বিরোধও বলতেন না, বলতেন নিজেদের মধ্যে অসন্তোষ। অন্যদিকে আল্লামা শফিও যে একেবারে অসতর্ক ছিলেন তা নয়। কওমি অঙনের তি হয় এমন কোন বক্তব্য তিনিও দিতেন না। হঠাৎ বেফাস কিছু যদি বলে ফেলে, এই চিন্তা থেকে গণমাধ্যমেও তেমন কোন কথা বলতেন না দু‘জনই। গণমাধ্যমকর্মী থেকে দুরে রাখতে নিজেরা কোন মুঠোফোনও ব্যবহার করতেন না। গণমাধ্যমের ফোন যেত তাদের প্রেস সচিবের কাছে। বিষয় জেনে-শুনে স্থির হওয়ার পর গণমাধ্যকর্মীর ভাগ্যে জুটত কথা বলা।
সর্বশেষ গত ৯ জুলাই দু‘পরে বিরোধ মিটিয়ে সমঝোতার বিবৃতি দিয়েছিলেন আল্লামা শফি ও জুনাইদ বাবুনগরী। কিন্তু দু‘মাসের মাথায় গত বুধবার দুপুরে হঠাৎ শুরু হয় মাদ্রাসায় ছাত্রদের বিােভ। মাদ্রাসার ফটকগুলোতে তালা লাগিয়ে বিােভ করেন ছাত্ররা। যাতে বহিরাগত বা প্রশাসনের কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব উপস্থিত হলেও মাদ্রাসার মসজিদের মাইক থেকে বার বার ঘোষণা দেওয়া হয় যাতে তারা সেখানে প্রবেশ না করে। বলা হচ্ছিল-এই ছাত্র বিােভ মাদ্রাসার অভ্যন্তÍীরণ বিষয়। যা মাদ্রাসার শুরা মজলিস ছাড়া সমাধানের কোন এখতিয়ার প্রশাসনের নেই। প্রশাসন যদি জোর করে প্রবেশ করে কোন রকম হস্তপে করে তার দায় প্রশাসনকে নিতে হবে। ব্যস, প্রশাসনও শান্তি বিনষ্টের শঙ্কায় মাদ্রাসায় প্রবেশ করেনি। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার রাশেদুল হক বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাদ্রাসার চারপাশে অবস্থান নেয় পুলিশ। রাত ১১ টার পর ছাত্র বিােভ থামে। কারণ এর আগে মাদ্রাসার শুরা মজলিসের তিন সদস্য বৈঠকে মাদ্রাসা থেকে শফিপূত্র আনাস মাদানীকে বহিষ্কারের দাবি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্রদের ৬ দফা দাবির অন্যতম ছিল এটি। এরপরের দাবি, মাদ্রসার মহাপরিচালক থেকে আল্লামা শফির সম্মানজনক অব্যাহতি, এছাড়া মাদ্রাসা থেকে আনাস মাদানী কর্তৃক চাকুরিচ্যুত শিক-কর্মচারীদের বহাল, আনাস মাদানী কর্তৃক শিক-কর্মচারীদের নিয়োগ বাতিল, শিার্থীদের উপর সবধরণের জুলুম ও হয়রানি বন্ধ, মাদ্রাসার শুরা মজলিস থেকে আওয়ামী লীগের দালাল উলামাদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের অর্ন্তভুক্ত করা। কিন্তু বৃহস্পতিবার ভোরে উঠে দুই মাসের জন্য মাদ্রাসা বন্ধের খবরে ফের বিােভে নামেন মাদ্রাসার ছাত্ররা। সকাল ১১টার দিকে তারা আল্লামা শফিকে অবরুদ্ধ ও আনাস মাদানীসহ অনুসারী শিকদের ক ভাংচুর করে। এ সময়ও পুলিশ, র্যাবের একটি দল মাদ্রাসার বাইরে অবস্থান নেয়। এরপর বিকেলে শিামন্ত্রলায় হাটহাজারী মাদ্রাসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। যা প্রত্যাখ্যান করে আরো প্তি হয়ে উঠে ছাত্ররা। একপর্যায়ে রাতে আল্লামা শফি নিজেই মহাপরিচালকের পদ থেকে সরে দাড়ানোর ঘোষণা দেন। আর এসব ঘটনায় পুরো চট্টগ্রামে নেমে আসে থমথমে অবস্থা। আশঙ্কা করা হচ্ছিল শাপলা চত্বরের মতো রাতে আরো একটি অভিযানের। এই আশঙ্কায় রাজধানী ঢাকা থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসার শুরা মজলিসের সদস্য নুরুল ইসলাম জিহাদী তড়িঘড়ি করে ভিডিও বার্তায় বলেন, শিামন্ত্রণালয় কর্তৃক হাটাহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা প্রত্যাহার করতে হবে, আন্দোলনরত ছাত্ররা যেন কোনোরকম হানাহানি ও আল্লামা শফির প্রতি অসম্মানজনক আচরণ না করে। ছাত্রদের উপর কোনো রকম হামলা বা মাদ্রাসায় প্রবেশ না করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া ডাকসু ভিপি নুরও আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর হামলা হলে রাজধানী অচল করে দেওয়ার হুমকি দেন। আর এসব কিছু পর্যবেণ ও বিশ্লেষণ করলে বুঝাই যায় হাটাহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলন অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। বিশ্লেষকদের মতে, এই ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত ােভের ফসল। যার শুরু ৫ মে শাপলা চত্বর থেকে। সেদিন লাখো কওমি জনতা ও জুনাইদ বাবুনগরীকে পুলিশের কব্জায় ফেলে চট্টগ্রামে চলে আসেন আল্লামা শফি ও তার ছেলে আনাস মাদানী। সেই থেকে চরম অসন্তোষ দানা বাঁধে কওমি আলেম-উলামাদের মাঝে। এতে মূলত দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে আলেম-উলামারা। সেই থেকে আল্লামা শফি ও জুনাইদ বাবুনগরীর বিরোধ বাড়তে থাকে। কওমি সনদ স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়া নিয়ে সেই বিরোধ তুঙ্গে উঠে। এ নিয়ে মহিবুল্লাহ বাবুনগরী, মুফতি ইজাহারুলসহ অনেক শীর্ষ আলেম দুরে সরে যায় আল্লামা শফির কাছ থেকে। আর এ জন্য দায়ী করা হয় শফিপূত্র আনাস মাদানীকে। মাদ্রাসার শিার্থীদের অভিযোগ, আনাস মাদানী শুধু নিজের স্বার্থে পিতাকে অন্যায় পথে পরিচালনা করেননি, মতা কুগিত করে প্রভাব বিস্তারও করেছেন হাটহাজারী মাদ্রাসায়। কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাক ও হেফাজতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। করেছেন সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন। করেছেন মাদ্রাসার শিক-কর্মচারীদের চাকুরিচ্যুত, নিয়োগ বাণিজ্য। গড়েছেন অঢেল সম্পদ। সরকারের দালাল হিসেবেও চিহ্নিত হন তিনি। যার ফসল এই ছাত্র আন্দোলন। জানা যায়, ছাত্র আন্দোলন শুরুর আগে গত শুক্রবার চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগর মাদ্রাসায় আল্লামা শফি বিরোধী কওমি উলামারা বৈঠক করেন। এতে চট্টগ্রামসহ দেশের শীর্ষ কওমি উলামারা উপস্থিত ছিলেন। যেখান থেকে সূচনা এই ছাত্র আন্দোলনের। বৈঠকের এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও এ বিষয়ে কিছুই জানেননা ভাব সংশ্লিষ্টদের। মুঠোফোন বন্ধসহ নানা কৌশলে তারা গণমাধ্যম থেকেও নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিরোধ ও বিবৃতি নিয়ে কওমি সমর্থকরা সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে নানারকম পোস্ট দিলেও এই ছাত্র আন্দোলন নিয়ে নিরব রয়েছেন। কোন কথা বলছেন না আল্লামা শফির অনুসারীরাও। এ বিষয়ে কথা বলতে বার বার ফোন করা হলেও কেটে দেন আনাস মাদানী। সূত্র জানায়, মাদ্রাসার মহাপরিচালক থেকে অব্যাহতি নেয়ার ঘোষণার পর আল্লামা শফি চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বার্ধক্যজনিত কারনে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। এর আগে তিনি দেশে-বিদেশে একাধিকবার চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রসঙ্গত, আল্লামা শফি গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে দুই দশক তিনি শিকতা করেছেন এই মাদ্রাসায়। মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক তার ছাত্র। তার বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা ইউনিয়নে।
উল্লেখ্য, প্রায় শতবর্ষী আল্লামা আহমদ শফী দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন।